শিক্ষাঙ্গন

গোটা বাংলাদেশকে ঢাকা ঘোষণা করুন!

প্রিন্ট
গোটা বাংলাদেশকে ঢাকা ঘোষণা করুন!

প্রকাশিত : ৬ অক্টোবর ২০২৫, বিকাল ৫:৪০ আপডেট : ৬ অক্টোবর ২০২৫, বিকাল ৫:৪৭



সাপ্তহিক শুক্র ও শনিবার ঢাকার ফার্মগেট, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, আজিমপুর, উত্তরা প্রায় প্রতিটি বাসস্টপে সকাল ৯টা ও দুপুর ২ টা সময় টর্নেডোর মতো একদল মানুষের হুমড়ি খাওয়া জটলা দেখা যায়। হাতে এডমিট, কাঁধে ব্যাগ। এদিক সেদিক ছুঁটছে। লক্ষ্য পরীক্ষার হল-এ পৌঁছানো। সাময়িক অতিথি। আবার চলে যাবেন রাতের মধ্যে। এরা কারা? আসলে তারা চাকরির পরীক্ষার্থী। কেউ ঢাকায় থাকছেন মেসে; বেশির ভাগ এসেছে বিভিন্ন বিভাগ, জেলা, উপজেলা, গ্রাম থেকে। এতদিনের উচ্চশিক্ষা পাস শেষে সরকারি চাকরির সোনার হরিণ ধরতে অজানা এক লড়াইয়ের যোদ্ধা তারা। 

 নগর ও পরিবেশবিদদের মতে- মেগাসিটির জনসংখ্যা ১ কোটি কিন্তু ঢাকা মেগাসিটির স্থায়ী বসবাসকৃত জনসংখ্যা ৩ কোটি ৩২ লাখের উপরে। চাপ তো ঢাকার উপর এমনিতেই অনেক৷ তারপর সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে সারাদেশ থেকে বিশাল সংখ্যক চাকরি প্রার্থীর চাপে নাজেহাল ঢাকা। সমস্ত সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হেড অফিসের অবস্থানও ঢাকায়। এমনকি

উচ্চশিক্ষা, চাকরির প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও জলবায়ু, দারিদ্র্য ও নানাবিধ কারণে \'প্রতিবছর নতুন করে ৬ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে ঢাকায়(ইত্তেফাক,২০২)।\' এত মানুষ ধারণের জন্য ঢাকা মোটেও প্রস্তুত নয়৷ ঢাকার যতটুকু ধারণ ক্ষমতা তা অনেক আগেই পূরণ হয়ে গিয়েছে। 

 বরং চাপ এতই বাড়ছে যে, নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে মৌলিক চাহিদা পূরণ; পানি, বিদ্যুৎ,গ্যাস, বাসস্থান সংকুলানে ঢাকার অবস্থা হ-য-ব-র-ল। শুধুমাত্র উচ্চশিক্ষা শেষে বছরে প্রায় ৭ লাখ শিক্ষার্থী ঢাকায় চাকরি প্রিপারেশন ও পরীক্ষার জন্য ঢাকায় অবস্থান করছে। বের হওয়া পরিসংখ্যান খুবই কম। তাহলে উপায়? উপায় ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণ করা। 



এ বিকেন্দ্রীকরণের ধাপের দ্রুত কাজটি হতে পারে চাকরি পরীক্ষার কেন্দ্রগুলো বিভাগীয় শহরে স্থানান্তর করা। এতে প্রাত্যহিক, সাপ্তাহিক চাপ হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার উপর সৃষ্ট স্থায়ী চাপের দিকটিও লাঘব হবে৷ যে চাকরি প্রার্থীটি দেশের বিভিন্ন কলেক, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষে একদিকে বেকার অন্যদিকে সূদুর রংপুর,কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, খুলনা, সাতক্ষীরা, বরিশাল, বরগুনা, চট্টগ্রাম,কক্সবাজার,ময়মনসিংহ,নেত্রকোনা প্রভৃতি থেকে ঢাকায় যাচ্ছে তার আর্থিক ও মানসিক দিকটি একবার চিন্তা করুন। কি অবস্থা তার। ক\'জনেরই বা ঢাকায় এক রাত থাকার পরিচিত মানুষ আছে? ইচ্ছে হলেই কেউ কারো বাসায় থাকতে পারে! পারে না। মেয়েদের বেলায় তা ম্যানেজ করা আরও কঠিন। এমনও চাকরি প্রার্থী আছেন যারা উচ্চশিক্ষা শেষে টিউশন করিয়ে ফরম পূরণ করাসহ যাবতীয় খরচ নিজে বহন করে মেসে থেকে চাকরি প্রিপারেশন নিচ্ছেন। কেউ কেউ টাকা ঋণ,ধার করে দূর-দূরান্ত থেকে সপ্তাহে সপ্তাহে ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষা অংশগ্রহণ করেন। যা প্রকৃতপক্ষে বেশ কষ্টকর। আবার তাদের মধ্যে যেসব নারী প্রার্থী আছেন এবং যার আছে সন্তান; তারা তো দূরত্ব ও নিরাপত্তার অভাবে পরীক্ষা দেন না। অথচ তাকে দীর্ঘ ৫/৬ বছর অপেক্ষা করে ডিগ্রি অর্জন করতে হয়েছে। মেধা যাচাইয়ে সুযোগ বঞ্চিত দরুণ অর্জিত ডিগ্রির ফলাফল মূল্য শূন্য। চাকরি হওয়া না হওয়া বিষয়টি পরের কথা। অনেকে ফর্ম পূরণ করে যাতায়াত ও থাকার অভাবে নিয়মিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেন না। চাকরির বয়স তো আর তাদের স্থির থাকে না। বাড়ছে। এরাও সামাজিকভাবে সুযোগ বঞ্চিত বেকার।



বাংলাদেশে ১৯৫২-২০২৪ জুলাই গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত যতগুলো গণ-আন্দোলন সংগঠিত হয়েছে সবগুলোর মূলে রাষ্ট্র কর্তৃক মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যর্থতায় দায়ী। যুগে যুগে এ বেকার তরুণ-তরুণীরা অকাতরে জীবন উৎসর্গ করেছে। ২৪\'র জুলাই গণঅভ্যুত্থান তো সংগঠিত হলো- সরকারি চাকরিতে সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্ট নিয়েই। কিন্তু সমাধান হলো কি! যারা শহিদ হলেন বা মজলুমের শিকার বেকার জনগোষ্ঠীর ক্ষোভান্বিত সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়গুলো। 

উল্টো পুরনো প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান। কেবল যে চাকরিতে কোটা বিলুপ্তি বিষয়টি ছিল তা নয়, বরং সমান সুযোগ ও অংশগ্রহণের দিকটিও ছিল এ গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা। তারপরও একজন তরুণ বেকারকে কর্মসংস্থানের জন্য পরীক্ষা দিতে সবকিছুর জন্য ঢাকায় যেতে হবে কেন! এবারের ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে তো প্রথম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ শহিদ হলেন। কই তিনি তো ঢাকার না। রংপুরের। ১৮ কোটা আন্দোলনে ছাত্রলীগের হাতে দিনেদুপুরে পঙ্গুত্ব বরণ করা তরিকুল তো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের। ঢাকার না। তাহলে একজন উচ্চশিক্ষিত বেকার কি রাজধানী ঢাকা যাওয়া ছাড়া বিভাগীয় অঞ্চলে বসে চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগটুকু পাবে না? 



 পৃথিবীর অন্যদেশে মানুষ পারে না? পারে। 

কলকাতা, সাংহাই, বেইজিং,শ্রীলঙ্কা দেশেতে চাকরির পরীক্ষার জন্য একজন প্রার্থীকে সপ্তাহ সপ্তাহে রাজধানীতে যেতে হয় না৷ তারা নিজ নিজ অঞ্চলে অংশগ্রহণ করেন। একজন শিক্ষার্থী যদি বিভাগীয় অঞ্চলে বসে এখন ভর্তি, ফরম পূরণ,উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত ও চাকরির আবেদন অনলাইনে সম্পন্ন করতে পারে তাহলে তাকে কেন নিজ বিভাগ ছেড়ে পরীক্ষার জন্য রাজধানীতে যেতে হবে!চাপ বাড়াতে হবে! সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। ঢাকারও বিকেন্দ্রীকরণ দরকার। বিকেন্দ্রীকরণ চায়ই চাই।



চাকরি পরীক্ষা বিভাগীয় শহরে স্থানান্তর নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেন দুর্নীতি, প্রশ্নফাঁস হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে। এটা এক ধরনের পুরনো ধ্যান-ধারণা। কেননা ঢাকায় পরীক্ষা হওয়া সত্ত্বেও অনেক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস, দুর্নীতি সংগঠিত হয়েছে। এখানের মূল বিষয় নিয়োগকর্তা ও প্রতিষ্ঠানের সততা ও মোরালিটি; ঢাকা কেন্দ্রীক পরীক্ষা আয়োজন নয়। আসলে একটা রাষ্ট্রে চাকরি, কর্মসংস্থান, জননিরাপত্তা এসব ইহজাগতিক বিষয়। এসব সমস্যা ও সুফলভোগীর মূলে মানুষ। আবার সমাধানের ঘটকও মানুষই। কাজেই মানুষ সৃষ্ট অ-ব্যবস্থাপনায় অসম্ভব বলতে কিছু নেই। স্বাধীনতারত্তোর বাংলাদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ক্রমবর্ধমান। ফলে এনটিআরসি, বিসিএসসহ অল্পকিছু প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা যদি বিভাগীয় শহরে নেওয়া যায়। অন্যসকল পরীক্ষাও নেওয়া সম্ভব। এতে ঢাকার উপর চাপ কমবে। যদি না পারেন তাহলে বলবো- গোটা বাংলাদেশকে ঢাকা ঘোষণা করুন। তাতেও চাকরির পরীক্ষাগুলো বিভাগীয় শহরে স্থানান্তর সম্ভব হবে। বেকার উচ্চশিক্ষিতদের কষ্ট লাঘব হবে। সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ বিষয় হলো - একজন শিক্ষার্থী যদি ভর্তি পরীক্ষায় একটা ফরম পূরণ করে পছন্দ ক্রম অনুসারে ভর্তি হতে পারে তাহলে ভর্তি পরীক্ষার এ পরিবর্তনের সাথে উচ্চশিক্ষা শেষে গ্রেড/ শ্রেণিভিত্তিক চাকরি পরীক্ষা প্রবর্তন সাপেক্ষ বিভাগীয় শহরে নেওয়া এখন সময়ে দাবি। যেন পছন্দক্রম গ্রেডের চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বিভিন্ন দপ্তর/ প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের সমান সুযোগ পেতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশেই এ সিস্টেম চালু আছে। পুরনো সিস্টেম থেকে বের হতে হবে। তাতে সময়, অর্থ ও মানসিক অপচয় রাষ্ট্র ও বেকার চাকরি প্রার্থীর উভয়েরই কমবে। চাপও কমবে ঢাকার উপর। 





মনির হোসেন 

লেকচারার 

বাংলা বিভাগ 

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর 

monirhossainhossain2021@gmail.com