খোলা কলম

রামনগর চামড়া মার্কেট যেন এক নিঃশব্দ আর্থসামাজিক কাব্য

প্রিন্ট
রামনগর চামড়া মার্কেট যেন এক নিঃশব্দ আর্থসামাজিক কাব্য

ছবি : দিনাজপুর চামড়া ব্যবসায়ী মালিক গ্রুপ


প্রকাশিত : ১২ এপ্রিল ২০২৫, সন্ধ্যা ৮:২২

দিনাজপুর জেলার রামনগর চামড়া মার্কেটের ইতিহাস যেন এক নিঃশব্দ আর্থসামাজিক কাব্য। এ বাজার শুধু চামড়া বেচাকেনার জায়গা নয়—এ এক অঞ্চলের প্রাণ, কোরবানির উৎসব-পরবর্তী এক বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু।


শুরুর দিনগুলো:

রামনগর চামড়া বাজারের গোড়াপত্তন হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতের শেষ দিকে, যখন দিনাজপুর ছিল পূর্ব বাংলার এক গুরুত্বপূর্ণ পশু ও কৃষি বাণিজ্যকেন্দ্র। প্রাথমিকভাবে হাট বসতো সপ্তাহে একদিন, যেখানে স্থানীয় কসাই, ব্যবসায়ী ও গ্রামবাসীরা কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে হাজির হতেন।


উত্থানের যুগ:

১৯৮০-৯০ এর দশকে এই হাট পরিণত হয় উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম চামড়া বাজারে। ঈদুল আজহার পরের দিন এখানে ৫০ হাজারেরও বেশি গরুর চামড়া এবং ৩০ হাজার ছাগলের চামড়া বেচাকেনা হতো। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, এমনকি ভারতের কিছু ব্যবসায়ীরাও এই হাটে আসতেন চামড়া সংগ্রহে। এই বাজার ঘিরে গড়ে উঠেছিল শতাধিক চামড়া ব্যবসায়ী ও পরিবহনকারীর নেটওয়ার্ক।


সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব:

এই বাজার শুধু ব্যবসা নয়, বরং হাজারো মানুষের জীবিকা, পরিবার চালানোর রশদ এবং স্থানীয় অর্থনীতির রক্তসঞ্চালন ছিল। অস্থায়ী শ্রমিক, পরিবহনচালক, খাবার দোকানদার—সকলেই উপকৃত হতেন এই চামড়া মৌসুম থেকে। মাদ্রাসাগুলোও চামড়া দানের মাধ্যমে এর সঙ্গে জড়িত ছিল, যা সমাজসেবার এক অনন্য ধারা সৃষ্টি করেছিল।


অবক্ষয়ের সূচনা:

২০০০ এর দশকের পর থেকে ধীরে ধীরে শুরু হয় পতনের অধ্যায়: চামড়ার দাম ধ্বসে পড়ে,সংগঠিত সিন্ডিকেট ও দালালচক্রের প্রভাব,সংরক্ষণের অভাব ও পরিবহন সমস্যা,কেন্দ্রভিত্তিক চামড়া শিল্পের একচেটিয়া দখল—এই সবই বাজারকে বিপন্ন করে তোলে।


আজকের প্রেক্ষাপট:

আজ যেখানে একসময় ১৭০ জন ব্যবসায়ীর পদচারণা ছিল, সেখানে মুষ্টিমেয় কয়েকজন অবশিষ্ট। বেশ কয়েক বছর ধরেই এই চামড়া বাজার যেন একটি পরিত্যক্ত ইতিহাস—যার বুক জুড়ে শুধুই ধুলোর স্তর, স্মৃতির ছায়া আর অব্যক্ত হাহাকার।

পরিশেষে বলা চলে রামনগর চামড়া মার্কেট শুধু একটি হাট নয়—এ এক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। তার গল্প হারিয়ে যাওয়ার আগেই প্রয়োজন পুনর্জীবনের পরিকল্পনা, সরকারের সদিচ্ছা ও সচেতন নাগরিক উদ্যোগ। ইতিহাসকে মৃত নয়, জীবন্ত রাখতে হবে।