খোলা কলম

চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য স্যারের স্মৃতি

প্রিন্ট
চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য স্যারের স্মৃতি

ছবি : লেখক


প্রকাশিত : ১২ মার্চ ২০২৫, দুপুর ১২:৪৮

১৯৮৩ সাল। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। ধুতি পড়া একমাত্র শিক্ষক হিসেবে একজনকে স্কুলের বিভিন্ন ক্লাস প্রবেশ করতে দেখি। অত্যন্ত সুদর্শন এক তরুণ। নাম চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য।  তিনি একদিন আমাদের ক্লাসে এসে সরাসরি আমাকে ডাকলেন, বললেন, হেডস্যারের রুমে চল। শুনে খানিকটা আঁতকে উঠি। কোন গুরুতর বিষয় না হলে হেডস্যারের রুমে ডাক পড়ে না। 

স্যার অবস্থা দেখে মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বললেন, তোমার কপালে কি আছে আজ কে জানে? বুকের হার্ট-বিট শোনা যাবে এমন অবস্থায় আমাকে নিয়ে হেডস্যারের রুমে প্রবেশ করলেন। ঢুকেই বললেন, ;আসামী হাজির”। হেডস্যার বললেন দাঁড়া দাঁড়া, আরে সোজা হয়ে দাঁড়া। ভয়ের কিছু নেই। জাতীয় শিশু মৌসুমি প্রতিযোগিতায় জিলা স্কুল অংশ গ্রহণ করবে। বিতর্কের টিমে তুই আছিস। পণ্ডিত স্যার তোদের উপজেলায় নিয়ে যাবে। 

জাতীয় শিশু মৌসুমি প্রতিযোগিতায় তিনটি বিষয় ছিল। যার সবকটি দলগত বিষয়। বিতর্ক, জারিগান ও দেওয়াল পত্রিকা। বিতর্ক ও জারিগানে চারজন করে অংশ নিত আর দেওয়াল পত্রিকায় মূলত সম্পাদক স্কুলের প্রতিনিধিত্ব করত।

বিতর্কের টিমে আমি ছাড়া বাকী তিনজন ছিলেন ক্লাস সেভেনের বড় ভাই। তারা হলেন শামীম ভাই, সাইমুম ভাই এবং সজল ভাই। এরা তিনজন আবার ছিলেন সেই ক্লাসের যথাক্রমে ফার্স্ট সেকেন্ড ও থার্ড বয়। জিলা স্কুল থেকে উপজেলা অনেক দূর বলে রিকশা নিতে হল।  দলের সবচেয়ে কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে স্যার আমাকে তাঁর সাথে নিলেন। গিয়ে দেখি আমরা ছাড়া আর কোন প্রতিযোগী নেই। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়া যাবে না দেখে উপজেলার লোকজন অন্য স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ডাকাডাকি করা শুরু করল। 

সকালের অনুষ্ঠান শুরু হল বিকেলে। সারাদিন আমরা বসে আছি। উপজেলার লোকজন আমাদের জন্য চা সিঙ্গারার ব্যবস্থা করলেন। আমরা সবাই খেলাম। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ স্যার কিছু খেলন না, এমন কি পানিটা পর্যন্ত মুখে দিলেন না।  যাওয়ার পথে স্যার আমাকে ডিবেটের যে টিপস দিয়েছিলেন সেটি দারুণ কাজে লেগেছিল।  আমরা কেবল উপজেলা পর্যায়ে নয় জাতীয় পর্যায়ে সবকটি বিতর্কে বিজয়ী হই। তবে পয়েন্ট তালিকায় পিছিয়ে থাকায় তৃতীয় শ্রেষ্ঠ দল নির্বাচিত হই। আজ এতদিন পরে মনে পড়ে স্যার এর পরামর্শ ছাড়া আমার বিতার্কিক হওয়া হয়ত অসম্ভব ছিল। আজ সেই মহান শিক্ষক পৃথিবী থেকে বিদায় নিলে।

একজন আপদ মস্তক শিক্ষক বললেন যার কথা সবার আগে মুখে আসে তিনি চন্দ্রশেখর স্যার। নরম, মৃদুভাষী কিন্তু দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন শিক্ষক।  শুদ্ধ বাচন ভঙ্গি এবং শান্ত স্বরে পড়ানো ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য।  গম্ভীর মুখের আড়ালে রসিক একজন মানুষ। মনে পড়ে একদিন ড্রয়িং স্যার নাসিরউদ্দিন ক্লাসে আসেননি, তাঁর বদলে এলেন চন্দ্রশেখর স্যার। আমরা আগে থেকে জানতাম নাসির স্যার অসুস্থ বলে তিনি ক্লাসে আসবেন না, তাঁর বদলে পণ্ডিত স্যার ক্লাস নেবেন। স্যার ক্লাসে এসে সবাইকে বললেন, বাড়ির কাজ বের করো। বাড়ির কাজ তো কেউ করে আনেনি। স্যার তখন পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা ইলাস্টিকের ফাঁদ বের করলেন। তারপর সেটা কানের মধ্যে লাগিয়ে টানতে শুরু করলেন। সবার কান লাল হয়ে গেল। স্যার কিন্তু কাউকে শাস্তি দিতেন না। আমরা অবাক হয়ে বললাম, স্যার এটা কি? স্যার বললেন, এটা হল নিত্য নতুন। আমরা স্যারের শাস্তিতে বিন্দুমাত্র মনঃক্ষুণ্ণ হলাম না, সবাই দারুণ মজা পেলাম। কারণ সেদিন সবাই শাস্তি পেয়েছিল।        

স্যার এর সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন, দেখো আমি বুড়ো হচ্ছি, কিন্তু তোমাদের বুড়ো হলে চলবে না। বড় হও, আদর্শ মানুষ হও। 

শেষ দেখার আগে নীরব থেকে সেই কথাটা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন শিক্ষক।