খোলা কলম

লেজুড়বৃত্তি ছাত্র রাজনীতি, না ছাত্র সংসদ নির্বাচন?

প্রিন্ট
লেজুড়বৃত্তি ছাত্র রাজনীতি, না ছাত্র সংসদ নির্বাচন?

ছবি : মনির হোসেন , শিক্ষক ও গবেষক, বাংলা বিভাগ , বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।


প্রকাশিত : ৫ জুলাই ২০২৫, দুপুর ১২:২৭

বাংলাদেশে বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষাঙ্গনে সহিংসতার জন্য লেজুড়বৃত্তি ছাত্র-রাজনীতিকে দায়ী করা হয়। এ প্রামাণিক অভিযোগ রয়েছে গত চার দশক জুড়ে। যখনই যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তার সমর্থনপুষ্ট ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে সিট, টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, জুলুম, অত্যাচার ও ক্যাম্পাস দখল-দারিত্বের দায়িত্ব বনে গিয়েছে। ফলে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্র রাজনীতির নামে দখল ও জুলুমবাজি রাজনীতির কারণে অসংখ্য মায়ের সন্তান খুনোখুনির শিকার হয়েছে। এ সংখ্যা নেহাত কম নয়, সংখ্যায় ধরলে তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১শ অধিক। শীর্ষে আছে চবি, রাবি ও ঢাবি। কলেজগুলোর এ সহিংসতার সংখ্যা বাদেই।  গবেষক আবদুল হাননান ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস বইতে লিখেছেন -" বিগত এসব সহিংসতার পেছনে স্বয়ং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনপুষ্ট ছাত্র সংগঠনগুলোই প্রকৃত অপরাধী। এবং মনে রাখা দরকার যে, এসব অপকর্মের পেছনে ক্ষমতা ও ক্ষমতা চর্চার একটা সখ্যতা আছে।" সবমিলিয়ে বাংলাদেশে আশি ও নব্বইয়ের দশক ছিল এ সহিংসমূলক ছাত্র রাজনীতির বিভীষিকা সময়কাল।

অথচ স্বাধীনতা পূর্বে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে  কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্র রাজনীতি কোনো রাজনৈতিক দলের আজ্ঞাবহ ছিল না। তারা ছিল স্বাধীন সংগঠন। সেই সময় এমন আক্রমণাত্মক, সহিংসমূলক ছাত্র রাজনীতি ইতিহাস পাওয়া যায় খুবই নগণ্য পরিসরে। তখন ছাত্ররা সামগ্রিকভাবে দেশ-দশের ও  ছাত্রদের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করেছে। জাতীয় স্বার্থে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এক ছাত্র কর্তৃক আরেকজন ছাত্রকে প্রকাশ্যে হত্যা, নির্যাতন করে মেরে ফেলবে তা ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু ১৯৭১ পর এর চিত্র গেলো সম্পূর্ণ উল্টে। ৯০'র পর বন্ধ করে দেওয়া হলো ছাত্র সংসদগুলো। যে ছাত্র সংসদ ছাত্রদের ভবিষ্যৎ দেশ পরিচালনায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব,  মানসিক ও সাংস্কৃতিক গুণাবলি বৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল তা রাষ্ট্রীয়ভাবেই বন্ধ করা হলো। মূলত খুবই সুকৌশলে একটা শ্রেণি

জাতীয় পর্যায়ে ভবিষ্যতে যেসব ছাত্ররা জাতির হাল ধরবে তাদের পথ রুদ্ধ করে দিয়ে "ব্যবসায়িক শ্রেণিকে " সরাসরি রাজনৈতিক ময়দানে আনার পথ সুগম করে দিয়েছিল। ফলে দেখা গেলো নব্বই পরবর্তী আমাদের দেশের সরকার গঠনে ব্যবসায়ী ও বড় পুঁজিপতি শ্রেণির ভূমিকা ও প্রভাব দিনদিন বেড়েছে। ব্যবসায়ী শ্রেণির চিন্তাই থাকে একমাত্র মুনাফা। তাই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যবসায়িক ক্ষতি থেকে বাঁচতে  আইন,কানুন সবকিছু তাদের ব্যসাবান্ধব অনুকূল রেখেই তৈরি করা হয়েছে। ৭ম ও ৮ম জাতীয় সাংসদ নির্বাচন ও পরবর্তী আপত্তিকর সমস্ত নির্বাচনে এ ধারায় পণ্য ব্যবসায়ী সাথে সাংস্কৃতিক ব্যবসায়ী যথা : ক্রিকেট,সংগীত, চলচিত্র পেশায় জড়িত এমন তারকাসম্পন্ন ও পরিচালক  লোকরা জড়ো হয়েছে আরও বেশি। মৌলিক ফলাফল হলো- এসব ব্যবসায়ী শ্রেণি কখনোই জনসাধারণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করবে না। অতীতকালে  করেও নি। তাই সময় এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে "ছাত্র সংসদ" নির্বাচন পুনরায় চালু করা। 


ছাত্র সংসদ নির্বাচন কী সহিংসতা বন্ধ করবে? অনেকেই বলবেন এটা লেজুড়বৃত্তি ছাত্র রাজনীতি ধরে রাখার ভিন্ন কৌশল। কিন্তু তা শতভাগ সঠিক না। কারণ জাতীয় নির্বাচন মেয়াদ হয় ৫ বছর। আর ছাত্র সংসদের মেয়াদ থাকে ১ বছর এবং এখানে কোনো দলীয় মনোনয়ন থাকে না৷ থাকে পরিষদ। সেক্ষেত্রে এককথায় উত্তর হবে- ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা যাবে। কারণ " ছাত্র সংসদ" নির্বাচন চালু করলে আইন অনুসারে ১ বছর মেয়াদে যে ছাত্র নির্বাচিত হয়ে অত্যাচার, দুর্নীতি ও শিক্ষাঙ্গনে ত্রাস সৃষ্টি করবে সে পরের বছর নির্বাচনে এমনিতেই ছিঁটকে পড়বে। কারণ আমাদের শিক্ষার্থীরা সহিংসতা চায় না৷ তারা শান্তিপ্রিয়। তবে যদিও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে কিন্তু এর ফিডব্যাপ ভালো হবে যদি প্রথমেই রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র রাজনীতির উপর তাদের " রাজনৈতিক ভর" করা ছেড়ে দেয়। তবে এরা ছাড়ে না এই  কারণে যে,  বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে ছাত্রদের বড় ভূমিকা আছে। এর কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে ছাত্র রাজনীতির উপর ভর করে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। কাজেই রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই নির্ভরশীলতা প্রকৃতভাবে ছেড়ে নিজেদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং ছাত্র সংসদে কিছু প্রয়োজনীয় মৌলিক আইন তৈরি করা যায় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসে হল দখল,টেন্ডারবাজি, সিট - নিয়োগ বাণিজ্য,জুলুম, নির্যাতন ও অপকর্মে জড়িত থাকা ছাত্র রাজনীতির  সহিংসতা অচিরেই বন্ধ করা যাবে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও ছাত্র সংসদ নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। যেখানে এসব অপকর্মের চিত্র নেই। তাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন ও দলীয়করণের প্রভাবও নগণ্য। ওসব দেশগুলোতে শিক্ষা শেষে ছাত্ররা তাদের লক্ষ্যাভিমুখী পেশায় যায়। তাই ২৪'র গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে সমস্ত ধরনের সহিংসতা রোধ করতে হলে, আগামী ভালো নেতৃত্ব পেতে  চাইলে "ছাত্র সংসদ" নির্বাচন অপরিহার্য।  আজকের ছাত্ররাই আগামী দিনের ভবিষ্যত। যারা বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ ও উন্নত রাষ্ট্র তৈরিতে কাজ করবে। আগামীর ভবিষ্যত বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে হলোও লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে "ছাত্র সংসদ" নির্বাচন চালু করা এখন সময়ের দাবি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ হওয়া ও বিগত দশকগুলোতে ক্যাম্পাসগুলোতে ক্ষমতাসীন দলীয় লেজুড়বৃত্তি করা ছাত্র সংগঠন কর্তৃক জুলুম,অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হওয়া সমস্ত  শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি। 


মনির হোসেন 
শিক্ষক ও গবেষক 
বাংলা বিভাগ 
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।